কোমরে ব্যথা হওয়ার অন্যতম কারণ শরীরের অতিরিক্ত ওজন। এছাড়াও ফ্যাসেট জয়েন্ট ও স্যাকরো ইলিয়াক জয়েন্ট
সঠিকভাবে কাজ না করলে কোমরে ব্যথা হতে পারে। একটি বিশেষ কারণের কথা বলছি, যা সচরাচর আমরা ভুলে যাই তা হল মাংসপেশির ইমব্যালেন্সেও কোমরে ব্যথা হয়
ডা. আলতাফ হোসেন সরকার
কোমরকে বলা হয় লাম্বো স্যাকরাল রিজিওন। এই রিজিওন ৫টি লাম্বার ভার্টিব্রা ও ১টি যুক্ত স্যাকরাল ভার্টিব্রা দ্বারা গঠিত। এই ভার্টিব্রা বা হাড়গুলোর মাঝে নরম এক প্রকার পদার্থ থাকে যাকে বলা হয় ডিস্ক। ডিস্ক সক অ্যাবজরভার বা শরীরের ঝাঁকুনি সহ্য করতে সহায়তা করে। শক্ত মজবুত স্পাইনের জন্য হাড়, ডিস্ক, লিগামেন্ট এবং মাংসপেশি বিশেষভাবে কাজ করে। এই স্পাইন বা শিরদাঁড়ার মধ্যে স্পাইনাল কর্ড থাকে। এ থেকে শরীরের ডান-বাম দিকে নার্ভ বের হয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যায়। ব্যাক পেইন হওয়ার অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে উলেখযোগ্য হচ্ছে মেকানিকাল (৭০ ভাগ), ডিজেনারেশন (১০ ভাগ), ডিস্কের অসুবিধা জন্য (৪ ভাগ), অস্টিওপোরেসিস (৪ ভাগ), স্পাইনাল ক্যানাল স্টেসিস (৩ ভাগ), স্পন্ডিলোলিসথেসিস (২ ভাগ) এবং অন্যান্য কারণ (৭ ভাগ)।
সমাজের প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের মধ্যে ১০ ভাগ ক্রনিক পেইনে ভোগেন। এই ১০ ভাগের মধ্যে কোমর ব্যথার রোগীও রয়েছে। কর্মসংস্থান রিপোর্টে দেখা গেছে অফিস এক্সিকিউটিভদের মধ্যে ১২ ভাগ কর্মকর্তা কোমর ব্যথায় ভোগেন।
কোমর ব্যথার বিশেষ কারণ হচ্ছে পোশ্চার বা বসার ভঙ্গি। যদি আমরা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে কিংবা সামনে ঝুঁকে কাজ করি অথবা হঠাৎ করে সামনে ঝুঁকে কোন জিনিস উঠাই কিংবা ঘরের আসবাবপত্র ধরে ধাক্কা দিই অথবা জিনিসপত্র অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করি তাহলে আমাদের কোমর ব্যথা হতে পারে। এছাড়াও সঠিক নয় এমন ভঙ্গিতে কাজ করলে এ ব্যথা হতে পারে। যদি কখনও আমরা কোমরের উপর পড়ে যাই অথবা কোমরে কোন প্রকার আঘাত পাই তাহলেও কোমর ব্যথা হতে পারে।
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কোমর ব্যথার অন্যতম কারণ। এছাড়াও ফ্যাসেট জয়েন্ট ও স্যাকরো ইলিয়াক জয়েন্ট সঠিকভাবে কাজ না করলে কোমর ব্যথা হতে পারে। একটি বিশেষ কারণের কথা বলছি, যা সচরাচর আমরা ভুলে যাই তা হল মাংসপেশির ইমব্যালেন্স।
কোমরে সমস্যা হলেই প্রথমে আমরা ব্যথা অনুভব করি। এই ব্যথা লোকাল অথবা রেফার্ড হতে পারে। ব্যথা কোমরে থাকতে পারে আবার কোমর থেকে বাটক, উরু অথবা পায়ের নিচের অংশে ব্যথা অনুভূত হয়। এই ব্যথা হঠাৎ করে হতে পারে আবার আস্তে আস্তেও হতে পারে। ব্যথার জন্য আমাদের দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হয়, চলাফেরার গতিও কমে যায়। অনেক সময় এই ব্যথা শোয়া, বসা, দাঁড়ালে অথবা হাঁটার সময় কম-বেশি হতে পারে। কাশি দিলেও কখনও কখনও এই ব্যথা হতে পারে।
কোমরের শিরদাঁড়ার পাশের মাংস চাপ দিলে এবং তলপেটের মাংসে চাপ দিলেও এই ব্যথা অনুভব করা যেতে পারে। এই উপসর্গগুলো নির্ভর করে রোগীর স্পাইনের কোন অংশে কি পরিমাণ অসুস্থতা হয়েছে তার ওপর।
রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর ইতিহাস জানা দরকার, কি কি উপসর্গ হয় এবং সঠিক ফিজিওথেরাপিউটিক এক্সামিনেশন করা দরকার। রোগের ইতিহাস ও পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যাক পেইন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেন। যেমন- কখন ব্যথা শুরু হয়েছে, এ ব্যথা কোথা থেকে কোথায় যায়, আপনি এখন কেমন বোধ করছেন, কখন এ ব্যথা শুরু হয়েছিল এবং কখন ব্যথা কমে গেছে এবং এখন ব্যথা আছে কিনা? কি ধরনের চিকিৎসায় আপনি ভালো বোধ করেন বা ব্যথা থাকে না। কি কাজ করলে আপনার এ ব্যথা কমে যায় অথবা ব্যথা থাকে না। শোয়া, বসা, দাঁড়ানো অথবা হাঁটার সঙ্গে এ ব্যথার কোন সম্পর্ক আছে কি?
এরপর ফিজিওথেরাপিস্ট আপনার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরীক্ষা করবেন এবং এ পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার সময় ফিজিওথেরাপিস্ট বের করবেন কোথায় আপনার অসুবিধা যেমন- অসুবিধা কি হাড়ে, ডিস্কে, টেন্ডোনে, লিগামেন্টে অথবা মাংসে?
মনে করুন আপনার মাংসে অসুবিধা; মাংসের কোন অংশে অসুবিধা একজন ফিজিওথেরাপিস্ট সেটা বের করতে পারবে। এ ছাড়াও আপনার দরকার হতে পারে এক্সরে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই এবং রক্ত পরীক্ষা।
এই পরীক্ষার মাধ্যমে অনেকাংশে বোঝা যায় আপনার ক্যান্সার, ইনফেকশন, ইনফ্লামেশন অথবা সিস্ট আছে কিনা? একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো ওষুধ খেলে সবচেয়ে ভালো হয় তাছাড়াও যেখানে ব্যথা আছে সেই ব্যথার জায়গায় ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করতে পারেন। খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে, যেমন প্রচুর পানি ও মৌসুমি ফল বেশি খেতে হবে। খাদ্য তালিকায় আদার রস এবং পেঁপে থাকবে হবে। ভাত ও ভাতজাতীয় খাবার কম খেতে হবে। গড়ে ৮ ঘণ্টা ঘুমালে এ রোগ থেকে আরও দ্রুত আরোগ্য পাওয়া যায়। আশা করি আপনারা যারা কোমর ব্যথার কষ্টে ভুগছেন এ চিকিৎসার মাধ্যমে দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন।
ফিজিওথেরাপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হচ্ছে ম্যানুয়াল থেরাপি। এই ম্যানুয়াল থেরাপির সঙ্গে লো-লেভেল লেজার থেরাপি, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি, ওয়াক্স প্যাক থেরাপি, ক্রায়োথেরাপি এবং লাম্বার করসেট হিসেবে ট্রনাসভার্সাস অ্যাবডোমিনিস ব্যবহার করতে হবে। সম্পূর্ণ বিশ্রাম আপনার অসুস্থতা বাড়াতে পারে। ঘরের মধ্যে ছোট ছোট কাজ অথবা ঘুরে বেড়াতে হবে যা আপনার অসুস্থতা সারাতে সাহায্য করবে। মনে রাখতে হবে আপনার ডিস্ক আপনার মুভমেন্টের ওপর বেঁচে থাকে।
লেখক : ব্যাকপেইন বিশেষজ্ঞ, লেজার ফিজিওথেরাপি সেন্টার, পান্থপথ, ঢাকা।